‘কলিজাখালী’ আজিমুন্নেসা

দুপুরের খাবারগুলি নেড়ে চেড়ে দেখছিলেন আজিমুন্নেসা। হরিনের মাংস, কচি পাঁঠার ঝোল, মুরগির বাহারি পদ, সবই রয়েছে। কিন্তু যা খুঁজছেন তা নেই পাতে। খানসামা একটু দূরে দাঁড়িয়ে, তার দিকে একবার আড় চোখে তাকালেন নবাবজাদী। বিরক্ত স্বরে জানতে চাইলেন সেই পদ কোথায় ? “জি, আজ কে কলিজা পাওয়া যায়নি।” মাথা ও চোখ নামিয়ে উত্তর দেয় খানসামা। মুহূর্তের নিস্তব্ধতা আর তার পরেই সব খাবার ছুঁড়ে ফেলে দেয় নবাবজাদী। উন্মাদের মতো চিৎকার করতে থাকে সে।

ছুটে আসেন নবাব, তাঁর মেয়েকে সামলাতে। কিন্তু কিছুতেই মেয়েকে শান্ত করতে পারলেন না। মেয়ের এক রা, কচি বাচ্চার কলেজা চাই। তা না খেতে পারলে সে শান্ত হবেনা।

এমনটা ছিলেন না আজিমুন্নেসা। বাবা বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর লাডলি মেয়ে সে। কিন্তু একটা ঘটনা তাকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়।

আওরঙ্গজেব তখন দিল্লির মসনদে আর বাংলার সুবা মুর্শিদকুলি খাঁর অধীনে। চুক্তি মতো প্রতি মাসের নির্ধারিত দিনে তিনি বাদশা সালামত কে ১কোটি ৩০ লক্ষ রৌপ্য মুদ্রা ভেট পাঠাতেন। এই ভেট দিতে এক বার তাঁর পুত্র নবাবজাদা ইয়াহিয়া খান গিয়েছিলেন। পথে দুর্ভাগ্য বসত কিছু মুদ্রা পরে যায়। মূল্য হিসাবে যা ছিল অতি নগণ্য। কিন্তু মুর্শিদকুলির কাছে ছিল তা “গুন্হা”। এই পাপের জন্য নিজের পুত্র নবাবজাদা ইয়াহিয়া খানকে হত্যা করেন।

বাবার এই রূপের সঙ্গে আজিমুন্নেসার পরিচয় ছিল না। দাদার অপমৃত্যু আজিমুন্নেসাকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। সে ধীরে ধীরে এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়। কোনো ওষুধই তাকে সুস্থ করে তুলতে পারছিলনা। মুর্শিদকুলিও নিজের ছোট মেয়ের এই অবস্থা আর দেখতে পারছিলেন না।

এমতবস্থায় এক হাকিম আসেন নবাবজাদীকে দেখতে। তিনি মুর্শিদকুলিকে এক দাওয়াইয়ের কথা বলেন। রোজ ওকে তিন বছরের ছোট বাচ্চার কলিজা খাওয়াতে হবে। হাকিমের কথা মেনে নেন মুর্শিদকুলি।

কলিজা খাওয়াতেই হোক বা অন্য ওষুধের জন্যই হোক, ধীরে ধীরে আজিমুন্নেসা ঠিক হতে থাকেন। কিন্তু মুশকিল হল সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেও তিনি কলিজার স্বাদ ভুলতে পারেন নি। যেদিন তাকে সেটা দেওয়া হত না, সে দিন তিনি আর মানুষ থাকতেন না।

এহেন ‘কলিজাখালী’ আজিমুন্নেসার সমাধী রয়েছে মুর্শিদাবাদের মাহিমাপুর এলাকায়। লোকগাঁথায় রয়েছে, তাঁকে তাঁর বাবা নিজের হাতে জ্যান্ত সমাধী দেন। আবার অনেকে বলেন তাঁর স্বামী সুজা-উদ্দীন মুহাম্মদ খান তাকে জ্যান্ত সমাধী দেন।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান