মার্গারেটের ক্যালকাটা : ক্রিসমাস

ডিয়ার এলিজাবেথ,

তোমার চিঠি পেয়ে কি যে আনন্দ হয়েছে তা বলে বোঝাতে পারবো না। আজ প্রায় তিন বছর হল নিজের দেশ ছেড়ে এই দেশে রয়েছি। প্রথম দুবছর মাদ্রাজে আর বছর খানেক হতে চললো আছি ক্যালকাটাতে। চার্লস বলছিল আরও তিন-চার বছর এখানেই তার পোস্টিং থাকবে। তা ভালো, মাদ্রাজে বড় একা একা লাগত। এখানে অন্তত কিছু ফ্যামিলি রয়েছে আসে পাশে। তাদের একজন মিসেস টমলিনসন, খোদ লন্ডনের মহিলা। এ দেশে রয়েছেন ছ-সাত বছর ধরে। তাঁর বাড়িতেই গত পরশু ক্রিসমাস পার্টি ছিল। খুব আনন্দ করলাম সেদিন।

ক্যালকাটাতে যখন এসেছিলাম, শুনেছিলাম এখানকার ক্লাইমেট নাকি দু’রকমের। “হট” আর “ভেরি হট”, গরম আর খুব গরম। একমাত্র সান্তনা শীত। এখানকার শীতকালটা খুব মনোরম, লন্ডনের মতো বরফ পড়েনা, বরং ঠান্ডা হওয়ার শিড়শিড়ানি শরীরকে সতেজ করে তোলে। বাড়ির সামনের পুকুরে এখন টলটলে জল, উঠোনে সোনা রোদ্দুর। আর বাগানের ফুলগুলি দেখলে মনে হয়, সব যেন খুশিতে হাসছে। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই ক্যালকাটা যেন “ইডেন গার্ডেন”। জানতো এই নামে এক বাগানও রয়েছে এখানে।

এরই মধ্যে এসে পড়েছে ক্রিসমাস। চারিদিকে খুশির আবহাওয়া। বড়দিনের মুখেই এক সন্ধ্যায় জি-জি’র (গভর্নর জেনারেল) ওখানে নেমন্তন্ন ছিল। দু’ ঘন্টা ধরে আমরা শুধু গল্পই করলাম। নাচ হওয়ার কথা উঠলেও তা আর হয়নি। শুনে মন খারাপ হয়েছিল। অথচ আমার স্বামী বলেছিল, নোয়া’জ আর্ক বাজবে। কিন্তু কিছুই তো হল না! তবে কানাঘুষো শুনছি জি-জি নাকি ‘বল’ লাগাচ্ছেন। হলে তো ভালোই হয়।

Government Place Calcutta

তবে মাসের প্রথম সপ্তাহেই একটা ‘ফ্যান্সি বল’ হয়েছিল। চার্লস চাইছিল আমি ‘মেষ পালিকা’র বেশে যাই। কিন্তু তা আমার মোটেই পছন্দ হয়নি। শেষে আমি ‘লর্ড ডানড্রেরি’ সেজে গিয়াছিলাম। দাড়ি, গোঁফ সবই ছিল। এই, কাউকে বোলো না যেন।

ক্রিসমাসে আমরা সেজেগুজে গির্জায় গিয়েছিলাম। গির্জার কথা যখন উঠলই তখন এই ফাঁকে তোমাকে একটা কথা বলে রাখি, যা আমি এখানে এসে জানলাম। ১৬৯৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নতুন সনদ দেওয়ার সময় শর্ত ছিল, ৫০০ টনের জাহাজমাত্রেই একজন করে পাদ্রী বয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেই সঙ্গে নিয়ম ছিল প্রত্যেক ‘গ্যারিসন’ এবং ‘ফ্যাক্টরি’তেও একজন করে পাদ্রী থাকবে। মজার বিষয় হল, কোম্পানি সুকৌশলে প্রথম নির্দেশটা এড়িয়ে গিয়েছিল। পাঁচশো’র বদলে তারা ডিঙা ভাসাতেন চারশো নিরানব্বই টনের। কেল্লা বা অফিসেও পাদ্রী থাকতেন কদাচিৎ। তবে শেষ পর্যন্ত রাজকীয় নির্দেশ অমান্য করা সম্ভব হয়নি। এখানে এসে শুনলাম, প্রথম দিকে ক্যালকাটায় পাদ্রীদের মাইনে ছিল বছরে একশো পাউন্ড। চিন্তা করতে পারছো ! শুধু তাই নয়, সঙ্গে ছিল অনেক রকমের ভাতা। এমনকি পালকি চড়ার খরচও পেতেন তারা। কাজের মধ্যে কাজ ছিল দিনে দু’বার প্রার্থনা আর সানডে তে সুসমাচার প্রচার করা। সুতরাং বুঝতেই পারছো রাজার হলে থাকতো তারা। এবং এখনও সেই ধারাই চলছে।

যাই হোক আমরা চার্চে গিয়ে দেখি প্রচুর ভিড়। ইংরেজদের থেকেও নেটিভরা বেশি চোখে পড়ে। তারা ভিড় জমিয়েছে সুন্দরী মেমদের দেখতে। আর কিছু লোক এসেছিল ইংরেজী কথাবার্তা শিখতে। গির্জায় নবাগত মেয়েদের হাত ধরে আসনে পৌঁছে দেওয়া এখানকার ইংলিশম্যানদের বিশেষ কাজ। আর আসন গুলিও সাজানো রয়েছে বিশেষ কায়দায়, যাতে মেয়েরা পুরুষদের দিকে মুখ করে বসতে পারে।

প্রার্থনা শেষ করে আমরা গেলাম আমাদের বন্ধুর বাড়িতে। দেবদারু পাতা, কলাগাছ আর গাঁদা ফুলের মালা দিয়ে জেমস সাজিয়েছে তার বাড়ি। কি সুন্দরই না লাগছিল বাড়িটা। সেখানে আমরা ব্রেকফাস্ট (নেটিভরা বলে ‘ছোট হাজরি’) সারলাম। জেমস ও তার স্ত্রী এমিলি খুব ভালো হোস্ট। আমাদের খুব খাতির যত্ন করছিল।

আর জেমসের পানীয়র সংগ্রহ দেখলে মাথা ঘুরে যাবে। চার্লস জানতে চাইল, “কি আছে ঘরে?” তাতে সে বললো, “বিয়ার আছে চার বোতল, ক্ল্যারেট বারো বোতল, স্যাক নয় বোতল, মদিরা একশো বোতলের মতো।” “আর ওয়াইন?” চার্লস আবার জানতে চাইল। একটু হেসে সে বললো “কেপ অব গুড হোপ থেকে আনা ফরাসি ওয়াইন আছে চার বোতল, তা ছাড়া সাদা ওয়াইন, লাল ওয়াইন, ক্লরেট, রেনিস, মসেল, পাম, পেরিয়া…” ওয়াইনেই নাম যেন শেষ হতে চায় না।

সেদিন ওদের ওখানে একটা নতুন ডিশ খেলাম, “বর্ধমান স্টু”, এই ডিশে নাকি মাছ মাংস সবই আছে। তাছাড়া লাঞ্চে ছিল আরও অনেক কিছু। যেগুলি মনে আছে, সেগুলি লিখছি – স্যুপ, রোস্ট মুরগি, কারি-রাইস, মটন পাই, ল্যাম চপ, রাইস পুডিং, টার্ট, চীজ ,মাখন-রুটি ইত্যাদি। সঙ্গে অবশ্যই মদও ছিল। ছুটির দিন, তাই লাঞ্চ শেষ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে গেল।

Auckland's Hotel, Calcutta

রাতে মিসেস টমলিনসনের বাড়িতে আমাদের নেমন্তন্ন ছিল তা তো চিঠির শুরুতেই জানিয়েছি। মিসেস টমলিনসন চিরকালই একটু গম্ভীর ও খিটখিটে মেজাজের। তবে সেদিন তিনিও বেশ হাসিখুশি ছিলেন। চার্লস বলল ওটা নাকি শ্যাম্পেনের ফল। আমি বিশ্বাস করিনি। সে যাই হোক বড়দিনের সন্ধ্যাটা খুব ভালো কাটলো।

বাড়ি ফেরার পর চার্লস নিজের ক্যালকাতায় কাটানো ক্রিসমাসের অভিজ্ঞতাগুলি বলছিল। বিয়ের আগে বেশ কয়েক বছর সে এখানেই পোস্টেড্ ছিল। “গভর্নমেন্ট হাউস” থেকে শুরু করে সাব-অল্টার্নের ঘর সর্বত্র ব্যস্ততা থাকত। সারাক্ষণ চলত অতিথির আনা-গোনা। সবাই একত্রিত হবার পর চলত রাতভর পানাহার। বাটলার পর্যন্ত নাকি রাতারাতি “বুটলিয়ার” সাহেব হয়ে যেত। সহকারীদের সঙ্গে নিয়ে কিচেন থেকে খাওয়ার টেবিল পর্যন্ত ছিল তার আনা-গোনা। আর তা নাকি ওয়েলিংটনের সমর কৌশলের মতোই দর্শনীয় হয়ে উঠত। আর অন্যদিকে দারোয়ানদের কাজ ছিল অতিথিদের খিদমতগার বাহিনীকে সার্চ করা, পাছে কাটা-চামচ ইত্যাদি খোয়া যায়। কি বিপদ বলো তো !

চার্লস বলছিল , ১৮২৭ সালে, লর্ড আমহার্স্টের জন্য স্যার চার্লস মেটকাফ আয়োজন করেছিলেন এমন এক সন্ধ্যার, যেখানে নিমন্ত্রিতরা সবাই এসেছিলেন শেক্সপিয়ারের নানা চরিত্রের সাজে সেজে।

ক্রিসমাসের সময়ে ক্যালকাটার এক অন্য রূপ দেখলাম। চারিদিকে এক অপরূপ খুশির ছোঁয়া। আমাদের আনন্দের সঙ্গে নেটিভরাও গা ভাসিয়েছে। যারা একটু বিত্তশালী তারা আমাদের উপহারে বোঝাই করা ডালি পাঠিয়েছে। কাশ্মীরি শাল থেকে শুরু করে দামী স্কচ কি নেই সেই ডালিতে। আমি কিছু পেন্টিংও পেয়েছি, উপহার স্বরূপ। ভাবছি সেগুলি দেওয়ালে লাগাবো।

ইংলেন্ড থেকে ইন্ডিয়াতে আসতে হবে জেনে আমি খুব মনমরা হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এখন আমার মন পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। আমি এখন ক্যালকাটাকে একটু এক্সপ্লোর করে দেখতে চাই। আর সেই অভিজ্ঞতা তোমার সঙ্গে ভাগ করে নেব চিঠির মাধ্যমে। আর তুমি আমাকে লন্ডনের কথা জানিও। আজ এই পর্যন্ত।

ভালোবাসা নিও।

তোমার
মার্গারেট
২৭ ডিসেম্বর, ১৮৮৭

ঋণ : বড়দিনের কলকাতা, শ্রীপান্থ 
ছবি : ব্রিটিশ লাইব্রেরি

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান